সোহিনীকে নিয়েই এবারের পুজোর গল্প – “সোহিনীর পুজো”। সোহিনীকে না চিনলে, পড়ে নিন –
সোহিনীর পুজো
—————————-
গলাটা কেঁপে গেল যেন, অস্পষ্ট স্বরে বললেন, “ভাল থাকিস”। চিকচিক করে উঠল সোহিনীর চোখ। সোহিনীর চিঠি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ইতিহাসের প্রাক্তন অধ্যাপক সত্যজিৎ বেশ অন্যমনস্ক – এ কী তাঁর মেয়ের লেখা! মেয়েকে বলছিলেন তাঁর নিজের শৈশব-কৈশোরের কথা। আর কেমনভাবে দুটো জীবন একই সত্যের মুখোমুখি, সময়টা শুধু আলাদা। ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে চোখ চলে যায় বাইরে, শরৎ আকাশ বিজয়াদশমীর বেদনা ভুলে হাসিখুশি। সত্যজিৎ-ও দেখেন, যেন একটুকরো ভাললাগা, মেঘের মতো আকাশের গায়ে ভাসমান। ভাবেন, “দীর্ঘ পরিশ্রম দিয়ে তৈরী জীবনটা সত্যিই এক পরম প্রাপ্তির”। পড়তে থাকেন লেখার বাকীটুকু।
গত বছরের বিজয়া দশমীর দিন থেকেই ছটফট করছিল সোহিনী, “আর নয়, অনেক হয়েছে! পুজোর কেনাকাটা, পুজোর শাড়ী – এই সব দেখনদারি জীবন আর নয়”। আর, ও ভাল করেই জানে, এই মুক্তি একেবারেই ওর নিজের হাতে। নিজের মনের সঙ্গে লড়াইটা একান্ত ওর নিজস্ব, শুধু বর সনৎ সঙ্গে থাকলেই হলো!
শহরতলীর পশ্চিমখোলা ভাড়াবাড়ির সামনের মাঠে পুজোর তোড়জোড় সেই অগাস্টের শেষ থেকে। সন্তুর আর তর সইছিল না, “মা, চলো, ঠাকুর তৈরী দেখে আসি”। সনৎ-এর সঙ্গে গেলও একদিন। ফিরেই কৌতূহলী সন্তু, “মা, তুমি ঠাকুর তৈরী দেখেছ? মাটির ঠাকুরে কি করে প্রাণ আসে, মা?” সোহিনী জানে না এর উত্তর। একটা সন্তোষজনক উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছিল সন্তুর প্রশ্নের, একটু সময় নিয়ে। ঠিক এমন সময়ই ইমনের ফোন, “কী রে, কি কি কিনলি? WhatsApp-এ ছবি পাঠাস”।
ভয়টা ছিলই। খুব ছোটবেলার বন্ধু ইমন এখন স্কুলের অঙ্কের দিদিমণি। সোহিনী ভূগোলের। স্কুল যদিও আলাদা। খুব কাছের বন্ধু ইমন। শুধু দুঃখ নয়, সব কথাই share করে ইমনের সঙ্গে। ইমনের প্রশ্নের কীই বা উত্তর দেবে! সত্যিটাই বলবে। আর ওকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ইমনের আরও একপ্রস্থ উপদেশ শুনবে।
বছর বেয়াল্লিশের সোহিনীর হাবভাব দেখে বেশ চিন্তিত চেনাজানারা – সংসার, পড়ানো ছাড়া সমাজের আর পাঁচটা টুকিটাকি হুল্লোড়ে উৎসাহ হারাচ্ছে ও।
ইমন সেদিন বলছিল, “এ-ও এক চালশে!”
-“ধ্যুস! তাই কখনো হয় না কি!”
শুনে, সনৎ বলেছিল, “চলো, Dr Sarkar-এর সঙ্গে দেখা করি তোমাকে নিয়ে”।
-“না না, এতে আবার ডাক্তারবাবুকে দেখানোর কি হল? সব তো ঠিকই আছে? আস্তে আস্তে সব সয়ে যাবে,” সোহিনী বেশ অপ্রস্তুত।
-“না, মানে, সবাই চিন্তায়, তাই বললাম কথাটা। তবে আমার মনে হয়, তুমিই ঠিক, অনেক তো হলো!” সনৎ দৃঢ় তার বক্তব্যে।
সোহিনীর এইসব অদ্ভুত ব্যবহার নতুন কিছু নয়। MA ক্লাসে সোহিনী Professor Ma’am-কে হঠাৎ জিগ্যেস করে বসেছিল, “আচ্ছা, এই ক্লাসরুমে বসেই সারা পৃথিবীর ভূগোল সব থেকে ভাল করে বোঝা যায় কি করে, একটু বলবেন Ma’am?” হো হো হাসির শব্দে ম্রিয়মান সোহিনী ভাবল, “কী বোকা আমি। সবাই কি করে যে বোঝে!” Ma’am সহানুভূতির স্বরে, “পরে বলব, এখন ক্লাসে concentrate করো”।
এই সেদিন। বারো ক্লাসের ছাত্রীদের জিগ্যেস করে বসলো, “তোমরা তো পৃথিবীর ভূগোল জানো। মানুষের মনের ভূগোল কি বোঝো?”
সোহিনী জানে, এসব কথা শুধু বাবাকেই বলা যায়। কেই বা শুনবে আর বুঝবে এই সব অবান্তর কথাবার্তা! সোহিনী তখন বছর দশেকের। জন্মদিনে gift-এর জন্য বায়না করছিল। বাবা বলেছিল, “মানুষের জীবনে একটা সময় আসে, যখন মানুষ প্রত্যেক জন্মদিনে চাওয়ার লিস্ট থেকে জিনিস কেটে বাদ দেয়”। তখন বোঝে নি, কিন্তু আজ একটু হলেও বোঝে, বাবা কি বলতে চেয়েছিল!
“বেয়াল্লিশে কি মানুষের এই বোধ আসে? জীবনসত্যে অবগাহন বলে কি একে? কেন অনেক কিছুই আজকাল ভাল লাগে না? সবাই FaceBook post দিচ্ছে জামা-কাপড় শাড়ীর। কটা দিন নতুন dress, খাওয়াদাওয়া, হৈচৈ – এই তো জীবন! কেন যে আজকাল আর ভাল্লাগে না, নিজেও জানে না সোহিনী। Dr Sarkar-এর সঙ্গে দেখা করাই বোধহয় ঠিক! Depression কি?” নিজের ভাবনা নিজের মনেই রাখে সোহিনী। শুধু সনৎ-কে জানিয়েছিল ও, “কোনো কারণ তো নেই অবসাদের”।
নিজের জন্য কিছুই কিনল না এবার। Uber করে গড়িয়াহাট-দক্ষিণাপণ ঘুরলো, দেখলো, কিন্তু কিনলো না কিছুই। সন্তুর জামাপ্যাণ্ট আর সনৎ-এর পাঞ্জাবি, ব্যাস্, এটুকুই পুজোর বাজার। সনৎ-এর চাপাচাপিতেও, সোহিনীর শান্ত উত্তর, “আমার তো অনেক আছে পরার, এবার নাই বা কিনলাম!” মনকে বোঝালো, “চাওয়ায় রাশটা টানতে হবে এখনই। দেরি হয়ে যাবে নইলে। কাউকে কিছু বলার তো দরকার নেই। থাক না, কে ভাল কে মন্দ-র হিসেবনিকেশ!”
রত্নাবৌদি এতদিনে কিছুটা হলেও চিনেছেন তাঁর নীচের তলার ভাড়াটে সোহিনীকে। একটু সমীহ করেই চলেন বোধহয়। এ কে তো স্কুলে পড়ায়, তার ওপর একটু যেন একগুঁয়ে। নিজে যা ভাল বুঝবে, তাই করবে। “এ পাড়ায় প্রথম পুজো তোমার, পড়শীদের সঙ্গে আলাপ করানোর দায়িত্বটা কিন্তু আমারই,” আগেই বলে রেখেছিলেন রত্নাবৌদি।
একাদশীর দিন মহামায়াতলায় বাবা মা-এর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে, বাবাকে একটা খাম দিয়ে সোহিনী বললো, “পড়ো”।
কিছু পরে, শুরু করলেন পড়তে সত্যজিৎ। সোহিনীর বহমান শব্দপ্রবাহ ধীরে পৌঁছে যায় সেই ত্রিবেণীসঙ্গমে, যেখানে ছোট্ট সোহিনী বাবা-মা-এর হাত ধরে হাঁটছে। কখনও বা গভীর সত্যের মুখোমুখি ওর লেখা -“ ……. মনের ভূগোলে দেখলাম অহং-এর উত্তুঙ্গ শিখর পেরিয়ে, জীবনের করুণাধারার নদী অপার ভালবাসার সাগরে ধাবমান…..”।
পড়তে পড়তে সত্যজিৎ হারিয়ে যান নিজের পরিবারের ইতিহাসে, নিজের কৈশোরে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চেতনার উৎস সন্ধানে। মনে পড়ল সত্যজিতের, সেবার পুজোর আগে খাতা-পেন্সিল দিয়ে বাবা বলল, “জামা-প্যান্ট এবার পারবো না রে!” অথচ, সপ্তমীর সকালেই জামাপ্যাণ্ট এলো। সে এক অত্যাশ্চর্য স্নেহ!
সম্বিৎ ফিরলো – সন্তু তখন জোরে জোরে আবৃত্তি করে শোনাচ্ছে দাদুকে –
“….
মাটির কাছে সহিষ্ণুতা
পেলাম আমি শিক্ষা,
আপন কাজে কঠোর হতে
পাষান দিল দীক্ষা।
ঝরনা তাহার সহজ গানে,
গান জাগাল আমার প্রাণে;
শ্যাম বনানী সরসতা
আমায় দিল ভিক্ষা।…..”।