ঐশ্বর্য

আজকের গল্প, চেনা গল্প। দেখুন তো, আপনার পরিচিত কেউ এই গল্পের কোন চরিত্র কিনা?

ঐশ্বর্য

কী আশ্চর্য! ক’দিন ধরেই ভাবছিলেন রত্নাবৌদি, জিগ্যেস করবেন একতলার ভাড়াটে-গিন্নি সোহিনীকে, “আচ্ছা, তোমাদের টিয়া পাখির খাঁচাটা তো সারাদিনই খোলা। উড়ে যায় না তো পাখিটা? ঘোরে ফেরে, আবার খাঁচায় ঢুকে যায়! কি করে এরকম পোষ মানালে গো?”

এসব প্রশ্নের উত্তর জানে না সোহিনী। সকাল থেকেই এত ব্যস্ত থাকে সে। সংসার সামলে, স্কুলের কাজ সামলে, ভাবতে পারে না এই সব। সকাল সকাল ছেলে সন্তুকে স্কুলে দিয়ে, নিজের স্কুলে যায় ভূগোলের দিদিমণি সোহিনী। বর সনৎ বেরিয়ে যায় নিজের সময় মতো। টিয়াকে যত্ন করার সময়ই বা কোথায়! সকাল-বিকেলের দানাপানি সন্তুই দেয়। খোলাই থাকে খাঁচা। উড়ে গেলে যাবে!

পশ্চিম খোলা বাড়িই পছন্দ সোহিনীর। ফ্ল্যাট কেনার স্বচ্ছলতা হয় নি এখনও। তাই নিজেই খুঁজে বের করেছে, শহরতলীর এই পশ্চিম খোলা ভাড়াবাড়ি। রত্নাবৌদিরই বাড়ি। বাড়ির পশ্চিমে বড় একটা খেলার মাঠ। বহুদূর চোখ যায় মাঠ পেরিয়ে, যেখানে গাছপালা ছোট হতে হতে, মাটিতে মিশেছে।

“কেন হঠাৎ পশ্চিমমুখো বাড়ি পছন্দ তোমার?”, জিগ্যেস করলে, সোহিনীর উত্তর, “বেশ বড় দিনটাকে পাওয়া যায়, তাই!”- “সকালটাই তো পেলে না তাহলে?”- “নাই বা পেলাম! সবই কি পেতে হবে নাকি! শেষটুকু ভাল লাগলে, খারাপটাই বা কি?”

মাস তিনেক হল ভাড়া এসেছে ওরা। মনটা থিতু হচ্ছে একটু একটু করে। হঠাৎ এই রোববার, গতকাল, বলা-কওয়া নেই, জল বন্ধ করে দিলেন রত্নাবৌদি। সন্তু-সনৎ বাড়িতে। জল একটু বেশীই খরচ হয় ছুটির দিনগুলোয়। তাবলে এই! চুপচাপ, রাস্তার মোড়ের কর্পোরেশনের কল থেকে জল এনে ছেলেকে চান করালো। রান্না করলো। নিজেদের চানের জল সনৎ-ই আনলো।

একই রকমের ব্যস্ততা আজও। একটু বেশীই তাড়াহুড়ো যেন। একে তো সোমবার, তার ওপর আবার জল নেই। স্কুল থেকে ফিরে, মাঝদুপুরে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাসন গুছোচ্ছে সোহিনী। দরজায় টোকা। দরজা খুলে, একটু অবাকই হলো রত্নাবৌদিকে দেখে।

-“কি ব্যাপার বলতো! বাইরে থেকে জল আনছো? একবার জিগ্যেস করলে তো পারতে, কেন জল বন্ধ করেছি? কিসের গুমোর তোমার এত?”, বেশ ঝাঁঝ নিয়েই রত্নাবৌদি।-“ছি ছি! কি যে বলেন, বৌদি! কিই বা আছে আমার বলুন? উপায়ও নেই, ক্ষমতাও নেই। তাই ভাবলাম…”, একটু অপ্রস্তুত সোহিনী।ডানা ঝাপটে, খাঁচায় ঢুকে গেল টিয়া। ব্যস ওইটুকুই। শান্ত সব তারপর। রত্নাবৌদির বোধহয় একটু মায়াই হল, জল খুলে দিলেন। বাথরুমের খুলে রাখা কলে, নিস্তব্ধতা চুরমার করে, আকস্মিক জলের শব্দে, একটুও বিচলিত হলো না পাখিটা। ভাবলেশহীন, খাঁচার আশ্রয়ে।

আজ বিকেলে, বেশ তাড়াতাড়িই ফিরল সনৎ, “লাঞ্চের পরেই অফিস ফাঁকা। ভ্যালেণ্টাইন্স ডে, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে সব বেরুবে! একা একা বসে থেকে কি আর করবো আমি, বাড়িই চলে এলাম।”

মধ্য ফেব্রুয়ারীর হাল্কা শীতের আমেজে, পশ্চিমের বারান্দায়, দুটো চায়ের কাপ হাতে, সোহিনী- সনৎ-এর অস্ফুট আলাপচারিতার কিছুই শোনা গেল না। ভেতরের ঘরে হোমওয়ার্ক করতে থাকা সন্তুর মনোযোগের কোন ব্যাঘাত ঘটলো না। উঁকিঝুকি মেরে বোঝার চেষ্টায় ব্যর্থ টিয়াও।
পশ্চিম দিগন্ত তখন রক্তাভ, প্রাত্যহিকতা ক্লিষ্ট জীবনের নিরুচ্চার ভালবাসাবাসির সমস্ত উষ্ণতা নিয়ে!