সাইকেল নিয়ে গনেশদা পুজোমণ্ডপের সামনে দাঁড়াতেই, দৌড়ে গিয়ে জিগ্যেস করলাম, “সপ্তমীর দিন সকালেও তোমাকে গান শেখাতে যেতে হচ্ছে, গনেশদা?”
হতাশ স্বরে গনেশদার আক্ষেপ, “জানিস, নিজেদের বাড়ীর সবার সবকিছু কেনাকাটা হয়ে গেল, কাজের লোকেদেরও বোনাস-জামাকাপড় দেওয়া হয়ে গেল, অথচ গানের মাস্টারের মাইনেটা দিতে দিতে সেই সপ্তমীর সকাল!
তোর বৌদির জন্য এই একটা শাড়ী কিনে আনলাম এখন। যাই তাড়াতাড়ি, সপ্তমী পুজো তো শুরু হল বলে!”
এ গল্পটা নতুন কিছু নয়, ফিরে ফিরে আসে। এদিকে বিশ্বায়িত পৃথিবীর সন্ধিপুজো দেখা এখন পাঁচশো ডলারের ধাক্কা। তুমি আর কবে সবার ঠাকুর হবে গো মা!
পুজোর সপ্তা দুয়েক আগে রবিজেঠু আসতেন। সব ভাইদের মাপ নিয়ে একই রকমের জামা তৈরী করে দিতেন। সবার একরঙের, একই কাপড়ের জামা। কোথাও কোন competition ছিল না!
অষ্টমীপুজোর হোমের শেষে যজ্ঞের টিপ পরাচ্ছে বড় পিসিমা। হারুদা, আব্বাসদা, সবাইকে এক এক করে। ডিগ্রীহীন, আত্মম্ভরিতাহীন গ্রামের এক সাধারণ মানুষের কাছে শিখলাম, “মানুষ” শব্দটার মানে! কালকূটের “শাম্ব” পড়তে পড়তে, বাঙ্কুদার কাছে বুঝতে ছুটেছি, ভারতবর্ষের পুরাণ, বিপন্ন ব্যক্তি এবং উত্তরণের পথ। আবার আব্বাসদার কাছে বুঝেছি, আবুল বাশারের “ফুল বৌ”-এর সমাজ রহস্য।
নবমীর মাছমাংসের সঙ্গে একটু চিনচিনে মনভার – যা! কাল তো দশমী!
দশমীর প্রতিমা বিসর্জনের, দৃষ্টি থেকে হারিয়ে যাওয়ার, সেই মুহূর্তটায় হাজার পায়রার ঝটপটানি, বুকের ভেতর! দশমী শিখিয়ে যায়, বারবার, অপেক্ষার মূল্য!
একাদশীর সকালটা শুধুই আশীর্বাদ নেওয়ার, নতমস্তকে।
না। আর নয়। অনেক তো হল। ঘুরে দাঁড়াতেই হবে এবার। পথচলা রাস্তার পাশে, ধুপধুনোর পুজোয় সামিল হবো, অহং-শূন্য ভক্তির প্রণামীতে। যতই হোক না সে স্মৃতির পুজো। সে তো আমারই একান্ত, নিজস্ব পুজো!
শরতের উজ্জ্বল আকাশ, পেঁজা তুলো মেঘ, শিউলি পেরিয়ে এক অনাদিকালের অমোঘ সত্য হয়ে ওঠে, এক সপ্তমীর সকালে গনেশদার দীর্ঘশ্বাস –
“অর্থহীনের জীবন, অপমানের জীবন।”