ওরা দৌড়চ্ছে। ঊর্ধশ্বাসে।পথচলতি মানুষ বিস্মিত, ধাক্কাও লাগল কয়েকজনের সঙ্গে। এই ভরা বিকেলে চোর-ডাকাত না কি? অনেকটা এগিয়ে পার্থ, একটু পিছনে তুলি, সঙ্গে আরও দু-তিন জন, একটু হাঁপিয়েই পড়েছে ওরা।
মুন্নাদি ট্যাক্সিতে উঠে পড়লে, সব শেষ!
প্রায় কুড়ি বছর হ’য়ে গেল মুন্নাদি ও মুন্নাদির গানের কথা শুনেছে লালু। সুযোগ হয় নি মুন্নাদির গান শোনার। সেই মুন্নাদি আসছে সৌম্যর বিয়েতে। লালু এসে থেকে ঘ্যানঘ্যান ক’রছে – মুন্নাদি আসছে, মুন্নাদির গান শুনবো।
দীর্ঘ দিন প্রবাসে লালু, সেই তুলির সঙ্গে বিয়ের পর থেকেই। মুন্নাদি তুলির জাঠতুতো দিদি। সৌম্য তুলির দিদি, রুমির ছেলে। তুলি-লালু কলকাতা এসেছে সৌম্যর বিয়ে উপলক্ষে।
মুন্নাদির কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত এই পরিবারের এক গর্বের ইতিহাস। যৌবনে মুন্নাদির একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে, ডাক্তার তুষারদার বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার গল্প, এ বাড়ির ছোটদের উত্তরাধিকার।
বর সৌম্যর গাড়ি কনে মধুরিমাকে নিয়ে বাড়ির সামনে এসে পৌঁছল। সেদিন সন্ধ্যেয় একটা ছোট্ট বৈঠকী, উপস্থিত অতিথিদের গান-বাজনা-আবৃত্তি নিয়ে করার ইচ্ছে রুমির, ছেলের বিয়ে বন্দোবস্ত হওয়ার পর থেকেই। কিন্তু, সেদিন সাড়া সকাল লালুর পাত্তা পাওয়া গেল না বিয়ে বাড়ির কোথাও।
পরিবারের নতুন মানুষটিকে আশীর্বাদ করতে এসেছিল মুন্নাদি দুপুর হওয়ার আগেই। বিকেল হতে না হতেই, আর আটকে রাখা যাচ্ছিল না মুন্নাদিকে। নাছোড়বান্দা মুন্নাদি বেরিয়ে পড়ল, বাড়ি-আগলানোর মেয়েটিকে ছাড়তে হবে, তার ছেলের মাধ্যমিক পরীক্ষা।
মুন্নাদি একটু হেঁটে রাস্তার মোড় থেকে ট্যাক্সি ধ’রবে। আর নিজেকে ধ’রে রাখতে পারলো না লালু। হতাশ লালু দীর্ঘশ্বাস ফেলে, পার্থকে ব’লেই ফেলল – “কুড়ি বছরের অপেক্ষা শেষ হ’য়ে গেল! সকালে পাকড়াশী থেকে কেনা হারমোনিয়ামটাও অর্থহীন হ’য়ে গেল!” লালুর এই কাতর আর্তনাদে দৌড় লাগালো পার্থ তৎক্ষণাৎ। পিছুপিছু তুলি। মুন্নাদিকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
সেই সন্ধ্যেয় ইতিহাসের পুনর্জন্ম, মুন্নাদির কণ্ঠে – “সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায়”! রবীন্দ্রপ্রবাসের ছোঁয়ায় আতুর আর এক প্রবাসী মন!
সে রাতে গান শেষ ক’রে ওরা যখন খেতে গেল, ক্যাটারারদের কেউ আর ছিল না। নিজেরাই নিয়ে, খাওয়া-গাওয়া শেষ ক’রে ওরা যখন বৌভাতের প্রস্তুতির কথা বলছিল, ঘুমহীন রাতের আকাশে শেষ তারাও নিভে গেছে, চারপাশে ভৈরবীর সুর!